ঢাকা,রোববার, ৫ মে ২০২৪

পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা, জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ

মগনামায় সাগর চ্যানেলে বালু উত্তোলন, হুমকিতে দুইশ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::  পেকুয়া উপজেলার মগনামায় বেড়িবাঁধ কেটে সাগর থেকে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট চক্র মগনামা ইউনিয়নের জেটিঘাটের নিকটে শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বঙ্গোপসাগরের চ্যানেল থেকে বালি উত্তোলন কাজ শুরু করেছে।

সাগরের তীরবর্তী মগনামা ইউনিয়নের পশ্চিমপ্রান্তে কুতুবদিয়া চ্যানেলের সংশ্লিষ্ট জেটিঘাটের উপকুলীয় বনবিভাগের মগনামা বনবিট কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনেই বালু উত্তোলন কাজ অব্যাহত রয়েছে। বালু উত্তোলনের শুরুতে প্রথমদিকে সিন্ডিকেট চক্রটি উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে পড়ে তোপের মুখে পড়লেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তা সামাল দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি সময়ে পেকুয়া উপজেলা সহকারী কমিশন (ভূমি) মীকি মারমা অনুকুলস্থলে অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলনের জন্য বসানো পাইপসহ কিছু যন্ত্রপাতিও জব্দ করে। এসময় উত্তোলন কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ড্রেজারের কর্মরত ৩ জনকে আটকও করেন। পরবর্তীতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ফের সেখানে শুরু হয়েছে বালু উত্তোলন কারবার।

জানা গেছে, মগনামা ইউনিয়নের জেটিঘাটের নিকট থেকে শুরু হয়ে বঙ্গোপসাগরের চ্যানেল ঘুরে প্রায় ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও তীরসংরক্ষন প্রকল্পের কাজ চলছে সেখানে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল মগনামা ইউনিয়নের ‘দক্ষিণ মগনামা কাকপাড়া থেকে মগনামা শরৎঘোনা’ পর্যন্ত বেড়িবাঁধে মাটি ভরাটসহ ব্লক বসানোর জন্য পাউবোর কাছ থেকে কার্যাদেশ পেয়েছেন। উপজেলার ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে অধিক ক্ষতিগ্রস্থ ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে মগনামা, উজানটিয়া ও রাজাখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশে ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে একশত ৯০ কোটি টাকা। বান্দরবান পাউবোর অধীনে ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ এখনো বিদ্যামান।

স্থানীয় পরিবেশ সচেতন মহল অভিযোগ তুলেছেন, বেড়িবাঁধ কেটে পাইপ বসিয়ে সাগর থেকে বালু উত্তোলনের কারণে বর্তমানে চরম হুমকিতে পড়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণাধীন তীরসংরক্ষন প্রকল্পের কাজ। পাশাপাশি এভাবে বালু উত্তোলনে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে উপকুলীয় জনপদের মানুষের মাঝে।

সরেজমিনে জানা গেছে, সাগর থেকে বালু উত্তোলনের মহোৎসব অব্যাহত রয়েছে। মগনামা জেটিঘাটের একটু উত্তরে উপকুলীয় বনবিট কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনেই বসানো হয়েছে পাইপ। পাউবোর বেড়িবাঁধ কেটে তলদেশ দিয়ে পাইপগুলো সাগর থেকে আনা হয়েছে লোকালয়ে। কুতুবদিয়া চ্যানেলের সাগর অংশ থেকে উপকুলীয় বনবিভাগের সৃজিত সবুজ বেষ্টুনির বাগানের ভেতর দিয়ে পাইপগুলো সঞ্চালন করা হয়েছে।

সাগর তীর থেকে এসব পাইপ প্রায় ১ কিলোমিটার বিস্তৃত হয়ে লবণ মাঠের উপর দিয়ে মগনামা ইউনিয়নের বিসমিল্লাহ সড়কের নিকট গিয়ে পৌছে। ফতেহআলীমার পাড়ার তমিজ আহমদের বাড়ির নিকট একটি বিশাল পুকুরে পাইপগুলো পৌছে। পুকুরের পৌছতে কাটা হয়েছে সড়ক। বালু খেকো সিন্ডিকেট এ প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করতে সড়ক ও জনপদ বিভাগের মালিকানাধীন বনৌজা শেখ হাসিনা নৌঘাঁটির সংযোগ মহাসড়ক কেটে ফেলে। গভীর রাতে সড়কটি কেটে মাটির তলদেশ দিয়ে পাইপ স্থাপন করে। ২০ ইঞ্চি প্রস্থের ওই পাইপ দিয়ে সাগর থেকে তোলা হচ্ছে বালু

স্থানীয় সুত্র জানায়, উপকুলীয় বনবিভাগের মগনামা বনবিট কর্মকর্তা মোবারক হোসেন শুরুতে বালু উত্তোলনে বাঁধা দেন। সপ্তাহ আগে কিছু পাইপ জব্দও করা হয়েছে। তবে একদম গুটিয়ে ফেলা হয়নি। মাত্র ৫/৬ দিনের ব্যবধানে ১৬ মার্চ সকাল থেকে ফের বালু উত্তোলন কাজ শুরু হয়েছে। এ দিকে সাগর থেকে বালু উত্তোলন নিয়ে এলাকায় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এভাবে সাগর থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে পেকুয়া উপজেলা প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ প্রেরণ করা হয়েছে।

গত ১৬ মার্চ অবৈধ পন্থায় বালু উত্তোলন থামাতে আওয়ামীলীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ মগনামা ইউনিয়ন শাখার সভাপতি মো: রোকন উদ্দিন বাদী হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পেকুয়াকে একটি অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগটিতে বালু উত্তোলনের জন্য ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ চৌধুরী ওয়াসিমকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আর্জিতে বলা হয়েছে।

অভিযোগকারী মগনামা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি রোকন উদ্দিন বলেন, বিএনপি নেতা চেয়ারম্যান ওয়াসিম এবং তার অনুগত লোকজন বালু উত্তোলনে জড়িত। এই চক্রটি টাকা কামাই করতে পাউবোর নির্মাণাধীণ বেড়িবাঁধ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে নির্মিতব্য মহাসড়ক কেটে ফেলেছেন।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামীলীগের কতিপয় নেতারা চেয়ারম্যান ওয়াসিমকে আস্কারা দিচ্ছেন। তাতে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন এই বিএনপি নেতা। তাঁর পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে ঝুঁিকতে পড়েছে বেড়িবাঁধ,সড়ক ও আশপাশের শত শত জনবসতি।

পেকুয়া উপজেলা প্রশাসনে লিখিত অভিযোগটি দেয়ার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মী। এরই প্রেক্ষিতে সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে বালু উত্তোলন বন্ধে নতুন লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন পেকুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মমতাজুল ইসলাম। একইদিন অভিযোগ জমা দিয়েছেন কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর, কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, পানি উন্নয়ন বোর্ড বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং পেকুয়ার ইউএনও’র দপ্তরে।

লিখিত অভিযোগটি পেয়েছেন বলে সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী। তাঁর প্রতিনিধি পাউবোর পেকুয়া উপজেলা শাখা কর্মকর্তা (এসও) মো.গিয়াস উদ্দিন বলেন, বেড়িবাঁধ কেটে সাগর থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি আমাদের অগোচরে হয়েছে। এমনকি ঘটনাটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজনও আমাদেরকে জানাইনি। এখন লিখিত অভিযোগ পেয়েছি, বিষয়টি সর্ম্পকে জেনেছি।

তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রানালয়ের সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধানকে অবহিত করেছি। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী প্রদক্ষেপ নেবে।

জানতে চাইলে উপকূলীয় বনবিভাগের মগনামা বনবিট কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, বালু উত্তোলনের শুরুতে আমরা দু’বার অভিযান দিয়েছি। কিন্তু প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যানের লোকজন আমাদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করছে। এ ভাবে বালু উত্তোলন করলে প্যারাবনের সৃজিত বাগান উজাড় হয়ে যাবে। সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।

পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোতাছেম বিল্যাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, বালু উত্তোলন কার্যক্রমের শুরুতে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটকও করেছে। এখন নতুন ভাবে বালু উত্তোলন করা হলে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

পাঠকের মতামত: